ডলারের বিরুদ্ধে বড় চ্যালেঞ্জ : ব্রিকস অভিন্ন মুদ্রা সফল হতে পারে যে কারণে

 

বিশ্বজুড়ে আলোচনায় ব্রিকস দেশগুলোর অভিন্ন মুদ্রা। গত এপ্রিলে এই জোট নতুন রিজার্ভ মুদ্রা চালুর ঘোষণা দেওয়ার পরই এর সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ্ব মুদ্রা ব্যবস্থায় যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে তাতে দিন দিনই ডলারবিরোধী অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে। চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে অনেক দেশ বিকল্প মুদ্রায় বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকছে।

এমনকি ব্রিকস জোটে যুক্ত হতে আগ্রহ দেখিয়েছে আরো ২৫টি দেশ। এতে ব্রিকসের সদস্যসংখ্যা বেড়ে হবে ৩০। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই দেশগুলো যদি ডলারের বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে বিকল্প মুদ্রা ব্যবহার করে, তবে বিশ্ব অর্থব্যবস্থায় আরেকটি শক্তিশালী মুদ্রার উত্থান ঘটবে, যা ডলারকে টলিয়ে দিতে পারে।
আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত হবে ব্রিকস দেশগুলোর পরবর্তী সম্মেলন।

এই সম্মেলনের মূল আলোচ্য বিষয় থাকবে ডলারের বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের বিষয়টি। সদস্য দেশগুলো নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেনে পাওনা পরিশোধ কিভাবে ডলারের বিকল্প মুদ্রায় করবে এ নিয়ে আলোচনা হবে। ফলে শুধু বেইজিং আর মস্কো নয়, ভারত থেকে শুরু করে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও এখন ডলারমুক্তকরণের দিকে ঝুঁকছে।

বর্তমানে ব্রিকস সদস্য দেশগুলো হচ্ছে—ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা।

এ বছরই জোটটি সম্প্রসারিত হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। জোটে আরো দেশের যোগদানের অনুমতি দেওয়ার বিষয়টিও আগস্টের সম্মেলনে আলোচনা হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে ডলারের আধিপত্যের অন্যতম বড় কারণ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক দেশ। যার জিডিপির আকার ২৫.৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বৈশ্বিক জিডিপির ২৪ শতাংশ। একটি দেশের অর্থনীতি যত শক্তিশালী, তার সম্পদের চাহিদা ও প্রভাবও তত বেশি।

সে কারণেই ডলার বর্তমানে শক্তিশালী অবস্থানে আছে।
এর বিপরীতে ব্রিকস দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি ৩২.৭২ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বৈশ্বিক জিডিপির ৩১.৫৯ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৭.১৬ ট্রিলিয়ন ডলার বেশি। ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখার সক্ষমতা আছে ব্রিকস দেশগুলোর। তাদের অভিন্ন মুদ্রাও ডলারের আধিপত্যের বিরুদ্ধে বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

বর্তমানে ব্রিকস সদস্যরা দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে ডলারের বিকল্প হিসেবে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য করছে। যেমন চীন-রাশিয়ার বাণিজ্যের ৭০ শতাংশের বেশি হচ্ছে স্থানীয় মুদ্রায়। কিন্তু অভিন্ন মুদ্রা থাকলে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর বাণিজ্যই কেবল বাড়বে তা নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নিজেদের মুদ্রা ডলারে রূপান্তরের যে উচ্চ ব্যয়, তা থেকেও রেহাই পাবে তারা।

তবে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর সবাই যে অভিন্ন কারণে এই উদ্যোগে সমর্থন দিচ্ছে তা নয়, বরং সবার ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থও রয়েছে। রাশিয়া ও চীন রাজনৈতিক বিবেচনায় এই ডি-ডলারাইজেশন প্রক্রিয়ায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সুইফট থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে তাদের। সে কারণে তারা ডলারভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ও পাশ কাটাতে চেষ্টা করছে। আবার চীন নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ানকে সামনে আনার চেষ্টা করছে। রাশিয়ার বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুদের ১৭ শতাংশই এখন ইউয়ানে রাখা আছে। ফলে তারা চীনা মুদ্রায় লেনদেন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে।

অন্যদিকে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের সামনে রাজনৈতিক কারণ না থাকলেও প্রায়োগিক কারণ থেকে তারা এই উদ্যোগে সমর্থন দিচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে। ফলে এসব দেশের আমদানি খরচ বেড়েছে।

ডলারের সংকট তো আছেই। ফলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে তাদের যে ঋণ আছে, তা পরিশোধে সংকটে পড়েছে দেশগুলো। এই বিবেচনায় তারা ডলারের বিকল্প মুদ্রায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করতে আগ্রহী।

ফরেন পলিসি সাময়িকীতে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে জোসেফ ডাব্লিউ সুলিভান বলেছেন, বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় ৩২ শতাংশ এখন ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর। ফলে ব্রিকস দেশগুলো বাণিজ্যের জন্য শুধু ব্রিকস মুদ্রাই ব্যবহার করবে, এমন চিন্তা বাস্তবসম্মত।

প্রথমত, এর মাধ্যমে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো আমদানি ব্যয় নির্বাহের জন্য দরকারি মুদ্রা নিজেরাই ছাপাতে পারবে। অর্থাৎ ব্রিকস সদস্য দেশগুলোর অনুমোদন সাপেক্ষে এই অর্থায়ন সহজেই করা সম্ভব হবে। ২০২২ সালে সামষ্টিকভাবে ব্রিকস দেশগুলোর লেনদেনের ভারসাম্য বা ব্যালান্স অব পেমেন্টে উদ্বৃত্ত ছিল ৩৮৭ বিলিয়ন ডলার, যার বেশির ভাগ জোগান দিয়েছে চীন। ফলে বিশ্বের অন্যান্য মুদ্রা জোট বাণিজ্যে যে ধরনের স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারেনি, ব্রিকস জোটের তা অর্জনের সম্ভাবনা আছে। এর আগের জোটগুলোর মতো ব্রিকসের মুদ্রা ইউনিয়ন সীমান্তবর্তী দেশগুলো নিয়ে হবে না, বরং এর সদস্য দেশগুলো অনেক ধরনের পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে। বিদ্যমান অনেক মুদ্রা জোটের চেয়ে এটা বেশি শক্তিশালী।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.